ফারিহান মাহমুদ

সবার আগে তাহলে ‘মান ভাষা’র একটা প্রমিতকৃত সংজ্ঞার দরকার। মানভাষা কীসের ভিত্তিতে ‘মানিত’ হবে? সংখ্যাগরিষ্ঠতা, নাকি লঘিষ্ঠতার ভিত্তিতে? নাকি, গরীব আর ধনীদের ব্যবহারের ভিত্তিতে? নাকি অঞ্চল ভিত্তিতে? নাকি অন্য কিছু?
আমাদের পুরান ঢাকা ও নতুন (অভিজাত) ঢাকার জন্য কি আলাদা আলাদা মান ভাষা হবে? নোয়াখালি, চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, কুষ্টিয়া—প্রতি অঞ্চলের জন্য কি আলাদা আলাদা মান ভাষা থাকবে?
তাহলে মান ভাষার জন্য প্রমিতকৃত আরেকটা প্রমিত শব্দকোষেরও দরকার, যেরূপ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করেছিল ১৯৩৬-এর দিকে; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৫৮-৬৪-এর দিকে শুরু করে ২০০০ সালে চূড়ান্ত করে। ধরুন, মান ভাষার জন্য এরূপ একটা শব্দকোষ গ্রন্থিত হলো, তাতেই কি সমগ্র বাংলাদেশ সেই মানভাষার শব্দাবলি প্রয়োগ করবে, বা প্রয়োগে বাধ্য থাকবে? বর্তমান প্রমিত শব্দগুলো কি সমগ্র বাংলাদেশের জনগণ সমভাবে ব্যবহার করেন? আমার জানা মতে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালির জন্য আঞ্চলিক ভাষার অভিধান আছে। এরূপ প্রতি অঞ্চলের জন্য যদি আলাদা আলাদা শব্দকোষ গঠন করা যায়, তখন সবগুলো শব্দকোষ মিলিয়ে আরেকটা প্রমিত শব্দকোষ তৈরি করতে হবে; অর্থাৎ আরেকজন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র প্রয়োজন পড়বে, আর সেই প্রমিতকৃত শব্দভাণ্ডারের জন্য আমাদেরকে আরো ৫০ বছর অপেক্ষা করতে হবে।
আমার আত্মীয়স্বজনের এক অংশ ঢাকাইয়া কুট্টি, আরেক অংশ অন্যান্য ঢাকায়। কুট্টিদের ভাষা সবসময়ই আমাদের বিনোদন দিয়ে আসছে। ওদের অনেক শব্দ আবার বুঝিও না, তবু বিশেষ এক পিকিউলিয়ারিটির কারণে সেই ভাষা খুব মজা করে শুনতে ইচ্ছে করে। ছোটবেলায় দুষ্টুমি করে বলতাম এটাকে ‘মেথরের ভাষা।’ পদ্মার তীর ঘেঁষে যে বিস্তৃত চরাঞ্চল, ওদের মুখের ভাষা পরিশুদ্ধ, পরিশীলিত ভাষা। আমরা অনেকাংশেই তাদের দ্বারা প্রভাবিত। ফরিদপুর ও কুষ্টিয়া অঞ্চলের ভাষাও এরূপ শ্রুতিমধুর ও মার্জিত।
প্রথম বাক্যেই ‘আমাগো’ শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে—বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর কথ্যরূপ হলো—আমাগো, আমাদের, মোগো, আমগো; এর বাইরেও আরো থাকা সম্ভব। এখন প্রমিত করবো কোন্‌টাকে? ‘মোগো’ বা ‘আমগো’ শব্দরা কী দোষ করলো? আর সবচেয়ে শ্রুতিমধুর ‘আমাদের’ শব্দটা তো প্রায় ১১০০ বছরের পুরনো ও সর্বজনগৃহীত একটি শব্দ, এটাকে ফেলে দিচ্ছেন বা ঠেলে দিচ্ছেন কেন?
সাহিত্যে বিভিন্ন ক্যারেক্টারের মুখে তার আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের নজির খুব পুরনোও নয়। কিন্তু ঐ আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের প্রাকট্যের কারণে অনেক ভালো মানের বইও পাঠক পড়তে পারেন নি।
আপনি কোন্‌ ভাষায় লিখবেন তা আপনাকে চাপিয়ে দেয়া ঠিক নয়, তাহলে আপনার বাক্‌ (লিখবার) স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। যেটাতে আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন সেটাতেই লিখুন। কাল-মহাকালই নির্ণয় করবে—আপনি টিকে আছেন, নাকি হারিয়ে গেছেন; আর এভাবেই ভাষার বিবর্তন ঘটতে থাকবে, শতাব্দী থেকে শতাব্দী।

Comments