সারওয়ার চৌধুরী


বেশি না, পঞ্চাশ বছর আগের মুখের ভাষা ও লেখার ভাষায় বিস্তর ব্যবধান পাওয়া যাবে পৃথিবীর যে-কোনো প্রতিষ্ঠিত ভাষায়। শব্দ প্রয়োগে, উচ্চারণে, অন্য ভাষার শব্দের মিশ্রণে বানানো শব্দ, সরাসরি অন্য ভাষার শব্দ ব্যবহার ইত্যাদি কারণে ‘শিক্ষিত’ বা ‘অশিক্ষিত’ মানুষের মুখের ভাষা ও লেখার ভাষায় পরিবর্তনটা আসে।
পঞ্চাশ বছর আগের আরবী ফারসি ইংরেজী উর্দূ হিন্দি মুখের ভাষা ও লেখার ভাষা আর এখনকার মুখের ভাষা ও লেখার ভাষায় রদবদলের ব্যাপারটা চোখে পড়ার মতো। ব্যাকরণের মানটাকে মেনেই এই বদলটা আসছে লেখার ভাষাতে। মুখের ভাষায় ব্যাকরণের আইন সকল সময় না-মানা সত্ত্বেও বোধ-সংবেদ-অনুভূতি বিনিময় হয়ে আসছে। অভিজ্ঞতায় পাইলাম কিছু ভাষার মধ্যে পরস্পর খুব সখ্য; ভারতের কেরালা রাজ্যের ‘মালায়ালাম’ ভাষার সাথে তামিলনাড়ু রাজ্যের ‘তামিল’ ও শ্রীলংকার ‘তামিল’ ভাষার লেখার অক্ষরে পার্থক্য আছে কিন্তু শব্দার্থে যথেষ্ট মিল। মালায়ালীরা তামিল বোঝে, তামিলরা মালায়ালী বোঝে। আবার ওই তামিল ও মালায়ালাম ভাষার সাথে ভারতের কর্নাটক রাজ্যের ‘কানাড়ি’ ভাষারও মিল আছে। কানাড়িভাষী মালায়ালাম ও তামিল বোঝে। উচ্চারণে হেরফের আছে। ওদিকে সংস্কৃত হ’তে অদলবদল হ’য়ে আগত অনেক শব্দ হিন্দিতে, তামিলে, মালায়ালামে, কানাড়িতে, এবং বাংলাতে আছে। শুধু উচ্চারণে ও লেখায় ব্যবধান বিদ্যমান। ইউরোপেও লাগোয়া দেশগুলোর পরস্পরের ভাষার সাথে মিল আছে। অস্ট্রীয়রা জার্মান ভাষা বোঝে ইত্যাদি।
আবার দেখুন, পঞ্চাশ বছর আগের সিলেটের, চট্টগ্রামের, কুমিল্লার, নোয়াখালি ইত্যাদি জেলা ভিত্তিক আঞ্চলিক ভাষা আর বর্তমানের আঞ্চলিক ভাষার মধ্যে ব্যবধান পাওয়া যাবে ‘শিক্ষিত’ ‘অশিক্ষিত’ নির্বিশেষে। কেউ বলতে পারেন আগের চাইতে এখন পরিশীল আঞ্চলিক ভাষাগুলো। আর লেখক-কবিরা তো শব্দ তৈরি করতেই আছেন। প্রবাসীদের মুখে মুখে ভাষার ভেতরে নতুন নতুন শব্দ ঢুকে যাচ্ছে। সিলেটে ও চট্টগ্রামে দেখেছি আরব প্রবাসী পরিবারগুলোতে ‘ইয়াল্লা খালাস’ খুব ব্যবহার হয়। এবং তা অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। ‘ইয়াল্লা খালাস’ মানে ‘ঠিক আছে, হয়েছে বা থাক’।
আর মুখের ভাষা পুরোটা সাহিত্যের ভাষা হওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করি? সাহিত্যের ভাষার শৈল্পিকতার একটা মান তো থাকা দরকার। ভাষা বিজ্ঞানীরা নাকি বলেন প্রতি ১৮ কিলোমিটার অন্তর মানুষের মুখের ভাষার ব্যবধান তৈরি হয়। আমাদের আঞ্চলিক ভাষাগুলোর মধ্যে বিস্তর পার্থক্যের কারণেই একটা সার্বজনীন সাহিত্য ভাষা থাকা দরকার। তবে হ্যাঁ, যেই লেখক সহজবোধ্য করে লিখতে পারেন, সেটা তার বিশেষ গুণ। কিন্তু কথা আছে, কিছু শিল্পসমৃদ্ধ লেখা, প্রায় সব ভাষাতেই, খুব সহজে বোধ-সংবেদ-ভাব ধরা পড়ে না। উত্তরাধুনিক শিল্প আলোচকেরা বলছেন, ভাষার শব্দগুলো বহুবিধ অর্থবোধক। পাঠকভেদে কিংবা একই পাঠকের বার বার পঠন থে’কে ভিন্ন অর্থ আসতেই পারে শব্দের, বাক্যের।

Comments